পালকির ইতিকথা

হারিয়ে যাওয়া পালকির ইতিকথা

পালকি! বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এক প্রাচীন বাহন। মানুষ বহন করার কাজেই এ পালকি ব্যবহার হয়ে থাকে। বিলাসবহুল বাহন হিসেবেই এর পরিচিতি। প্রাচীনকালে সাধারণত ধনী গোষ্ঠী এবং সম্ভ্রান্ত বংশের লোকেরা এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন। ১৭৫৮ সাল। গোটা উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন সদ্য পরাজিত নবাবের প্রতারিত হওয়া নিশ্বাসে, বিশ্বাসঘাতক শ্বাসরুদ্ধকর বিষাক্ত বাতাস। যে অন্তঃশত্রু বাতাস ছুটে চলেছে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কোমল মাটি ছুঁয়ে। অথচ এত কিছুর মধ্যে কোম্পানির লোকেরা ভাবতে বসেছে অন্য আরেকটি বিষয়। একটি অতি সাধারণ প্রচলিত বাহন যা কি না ভাবনায় ফেলে দিয়েছে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের।

পালকি, ইংরেজিতে পেলেঙ্কিউন বা সেডেন চেয়ার। সতেরো ও আঠারো শতকের বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের কর্তাব্যক্তিরা পড়লেন ভারি এক সমস্যার মধ্যে। নিত্যনৈমিত্তিক যাতায়াত, মালামাল স্থানান্তরে তারা অতি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন পালকির ওপর। তারা এতটাই অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন পালকিকে কেন্দ্র করে যে সে সময় মোটা টাকা মাইনে পাওয়া কর্তাব্যক্তিরা তো বটেই, কোম্পানির স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারীরাও ব্যাপক মাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়লেন এই বাহনটির ব্যবহারে।

পালকি চাকাবিহীন এক বাহন। তাই কয়েকজন মানুষকেই এই পালকি ঘাড়ে করে বহন করতে হয়। সাধারণত পালকিকে কয়েকজন ঘাড়ে ঝুলিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যারা পালকিকে ঘাড়ে বা, কাঁধে করে বহন করে থাকেন তাদের পালকির বেহারা বা, কাহার বলে। পালকির ভেতরে ১ জন বা, ২ জন থাকত, আর পালকির বেহারা হিসেবে থাকত ২ থেকে ৮ জন। আজ আমরা গ্রাম বাংলার এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পালকির ইতিহাস-ঐতিহ্য, উৎপত্তি থেকে শুরু করে আরো কিছু বিষয়ে জানার চেষ্টা করব।

পালকি

ধারণা করা হয় প্রাচীনকালে দেব-দেবীকে আরোহন বা, দেব-দেবীর মূর্তি বহনের জন্য পালকি সদৃশ বাহন ব্যবহার করা হতো। অনেক প্রাচীন মন্দিরেই পালকি দিয়ে দেবতাদের বহনের দৃশ্য ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরা হয়েছে। হিন্দুদের রামায়নেও আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০ সালের সময়ের দিকে পালকির উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইউরোপের উচ্চ শ্রেণীর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এই পালকিতে চলাচল করতেন। তবে উপমহাদেশে রেলগাড়ি প্রচলেন পর ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মাঝে পালকির ব্যবহার অনেকটাই কমে আসে।

ইউরোপের পালকিগুলোকে শোবার উপযোগী করে বানানো হতো। কোন কোন পালকি খোলা হতো আবার কোনটি হতো বন্ধ। মিশরীয় চিত্রকর্মেও পালকির দেখা পাওয়া যায়। পারস্য রাজ্যেও পালকির অস্তিত্ব ছিল। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা থেকে শুরু করে চতুর্দশ শতকে পর্যটক জন ম্যগনোলি ভ্রমণের জন্য পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। সম্রাট আকবরের শাসন আমলে এবং তারও পরবর্তি সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের জন্য প্রধান বাহন হিসেবে পালকিই ব্যবহৃত হতো।

আমাদের দেশে পালকি

বাংলাদেশে এক সময় অভিজাত শ্রেণীরা এই বাহনে চলাচল করতো। দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানেও এর ভালই প্রচলন ছিল। বিয়েতে বর এবং কনের জন্য পালকি ব্যবহারের প্রথা চালু ছিল। এছাড়াও অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে বা, অক্ষম মানুষকে বিভিন্ন স্থানে নেয়ার জন্যও পালকি ব্যবহার হতো।

বাংলাদেশের পালকিগুলো বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। এর গঠন শৈলীতেও রয়েছে ভিন্নতা। সবচেয়ে ছোট এবং সাধারণ নকশার পালকিকে ডুলি বলা হয়। এই ডুলি সাধারণত ২ জন বহন করে নিয়ে চলে।

কাঠ মিস্ত্রীরা সেগুন কাঠ, শিমুল কাঠ, গান কাঠ প্রভৃতি কাঠ দিয়ে তৈরি করতো পালকি। পালকির বহন করার দন্ডটিকে বাঁট বলে। এই বাঁট তৈরি হত বট গাছের বড় ঝুরি দিয়ে। তখন বাংলাদেশে তিন রকমের পালকি দেখা যেতো। সাধারণ পালকি, আয়না পালকি এবং ময়ূরপঙ্খি পালকি। সাধারণ পালকি দেখতে আয়তাকার ছিল। ঢালু ছাদ এবং চারদিকে কাঠের আবরণ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এর দু দিকে দুটি দরজাও থাকতো।

তবে উনবিংশ শতাব্দীতে এসে সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে যাতায়াতের বাহন হিসেবে পালকির ব্যবহার প্রায় বন্ধই হয়ে যায় বলা চলে। বিশেষ করে ১৯৩০ এর পর থেকে শহরাঞ্চলে রিক্সার প্রচলন শুরু হলে পালকির ব্যবহার উঠে যায়। বর্তমানে আমাদের পালকিকে আমাদের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই ধরা হয়। বেহারাদের কাঁধ থেকে পালকির স্থান এখন হয়েছে বিভিন্ন জাদুঘরে। সভ্যতা এবং বাস্তবতার কথা চিন্তা করলে পালকিকে হয়ত আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে আমরা এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে পালকির কথা ভুলে না যাই সেদিকে আমাদের সচেষ্ট দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

পালকির  নাম

সংস্কৃত “পল্যঙ্ক” বা, “পর্যঙ্ক” থেকে পালকি শব্দটি এসেছে । এর অর্থ খাট বা বিছানা হিন্দী এবং বাংলা উভয় ভাষায় এটাকে পালকি বলা হয়ে থাকে। পালি ভাষায় একে “পালোঙ্ক” বলা হয়। এই যানকে কোন কোণ জায়গায় ডুলি, শিবিকা এসব নামেও ডাকা হয়। পর্তুগীজরা এর নাম দিয়েছিলো পালাঙ্কুয়িন।

যেহেতু গ্রামের পর গ্রাম পালকি বয়ে নিয়ে যেতে হতো আর লোকসংখ্যা ও বসতবাড়ির ঘনত্ব কম ছিল সে সময়, তাই মাঝে মাঝেই ডাকাতের কবলে পড়তে হতো পালকির যাত্রী ও বেহারাদের। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে, ব্যক্তিগত অভিপ্রায় থেকে লক্ষ্য করা বিশ্লেষণ হলেও এটি একেবারে সত্য যে পালকি বহনকারী বেহারারা সে সময় অত পথ হেঁটে অমানবিক কষ্ট সহ্য করতেন। গ্রামকে গ্রাম যাত্রী কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই নিতান্ত তুচ্ছ বিষয় নয়। এর জন্য অমানুষিক পরিশ্রম ও কষ্ট ছিল বেহারাদের নিত্যসঙ্গী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *